হুন্ডি কি এবং হুন্ডি ব্যবসা কিভাবে করে ও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো
হন্ডিতে টাকা পাঠানো হয়তো সহজ, কিন্তু এটি অবৈধ এবং অনেক ক্ষেত্রে রিস্কিও। আজকের এই পোস্টে হন্ডি ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় গুলো আলোচনায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
Hundi ব্যবসা বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি টপিক। যে সিস্টেম অর্থনীতিতে একটি বিশাল নীতিবাচক প্রভাব ফেলছে। Remittance প্রবাহে আনছে ধস। যে সিস্টেম নিয়ে বর্তমান সরকারের রয়েছে এক্সট্রা নজরদারি। আসলে এই হুন্ডি কি? হুন্ডি ব্যবসা কিভাবে করে? এই হুন্ডিতে কিভাবে টাকা পাঠায়? আর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো কি বৈধ?
এমন আরো অনেক ধরণের প্রশ্নের উত্তর থাকছে এই পোস্টে। হুন্ডি সম্পর্কে একটি মুটামটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে এই পোস্টি সম্পূর্ণ পড়ুন। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
Table of Contents
হুন্ডি কি?
হুন্ডি হল একটি নিঃশর্ত লিখিত আদেশ বা শর্তহীন দলিল যা কেউ একজন তার অর্থ বা রেমিটেন্স হস্তান্তরের জন্য কোনো একজন ব্যাক্তির মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয়, এই ব্যাক্তি তার প্রতিনিধির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট এমাউন্টের টাকা আরেকজন ব্যাক্তির কাছে পৌছে দেয়।
এই ব্যবস্থা মুগল আমলে পরিচিতি লাভ করলেও কিন্তু ব্রিটিশ আমলে জনপ্রিয়তা পায়। তখন মানুষ বিভিন্ন কারণে নগদ অর্থ বহণে ঝুকি বিবেচনা করে বা সহজে তা হস্তান্তরের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করতো।
তবে বর্তমানে এটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার একটি অংশ হওয়ায় হুন্ডির কোনো আইনি মর্যাদা নেই। এখন প্রবাসী চাকুরিজীবীরা এই সিস্টেমের ব্যবহার করে থাকলেও তা আড়ালে ব্যবহার করছেন।
হুন্ডিতে কিভাবে টাকা পাঠায়?
হুন্ডিতে যিনি টাকা পাঠাতে চান তিনি সচরাচর কোনো হুন্ডি ব্যবসায়ির কাছে আসেন এবং কোথায় কোন দেশে কতো টাকা পাঠাতে হবে এবং কার কাছে পাঠাতে চান তার কিছু তথ্য দিয়ে সেই ব্যবসায়িকে তার টাকা বুঝিয়ে দেন।
তারপর সেই ব্যবসায়ি উক্ত দেশে উল্লেখিত স্থানের কাছাকাছি তার কোন এজেন্ট আছে তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং বলে দেন কোন জায়গায় ও কার কাছে কতো টাকা পৌছে দিতে হবে। তখন সেই এজেন্ট যার কাছে টাকা পৌছানো দরকার তার কাছে টাকা পৌছে দেন। এভাবেই মূলত হুন্ডিতে টাকা লেনদেন হয়ে থাকে।
হুন্ডি ব্যবসা কিভাবে করে?
ধরুন বিদেশে একজন শ্রমিক তার উপার্জিত টাকা একজন হুন্ডি ব্যবসায়ির কাছে নিয়ে গেলো। সেই ব্যবসায়ি দেশে তার কোনো এক এজেন্টকে কোথায় টাকা দিতে হবে বলে দিলে এজেন্ট সে অনুযায়ি টাকা পৌছে দিলো। এই পৌছে দেয়ার সময় প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যাবস্থার থেকেও কম লাগছে।
এখানে তারা (হুন্ডি) যে কাজটি করে তা হলো, ডলার রেট প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যা দিয়ে থাকে তার থেকে তুলনায় একটু বেশি দেয়। অর্থাৎ ডলারের রেট যদি ব্যাংকগুলো ৯৪ টাকা দেয় তবে তারা হয়তো ১০০ টাকা বা ১০৫ টাকা দেয়। এখানে তারা খুব কমই লাভ হিসেবে রাখে এবং যা রাখে তাই মূলত তাদের লাভ। এভাবেই তারা ব্যবসা করে থাকে।
আরো পড়ুন: এক্সচেঞ্জ ব্যবসা শুরু করার নিয়ম
হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর সুবিধা কি?
হুন্ডির বেশ জনপ্রিয়তা আছে, যার পেছনে এর কিছু সুবিধা আছে। সুবিধা গুলো হলো:
- টাকা পাঠানোর জন্য কাস্টমার কে অফিসিয়াল আওয়ারের মধ্যে এজেন্টের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। আসলে হুন্ডি ব্যবসায়িদের কোনো অফিসিয়াল আওয়ারই নেই।
- কাস্টমারকে এক্সট্রা কোনো ফর্ম পূরণ করতে হয় না।
- তাদের কাছ থেকে এক্সট্রা কোনো ফি নেয়া হয় না এই লেনদেনের জন্য।
- সবচেয়ে ভালো কথা হলো, কাস্টমার একটি তুলনামূলক ভালো এক্সচেইন্জ রেটও পায়।
আরো পড়ুন: ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে টাকা পাঠানোর নিয়ম
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো কি বৈধ না অবৈধ?
উপরের লেখা পড়ার পর আপনার কাছে হয়তো মনে হতে পারে যে হুন্ডিতো ভালোই করছে। তারা কম লাভ করে কাস্টমারকে বেশি দিচ্ছে। এখানে কাস্টমারও খুশি তারাও খুশি।
কিন্তু আপনি কি জানেন এই সিস্টেম অবৈধ? শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই এই হুন্ডি সিস্টেম অবৈধ। যেহেতু এই সিস্টেমের ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি কোনো লাভ হয়না এবং দেশের তেমন কোনো লাভ হয় না, বরং আরো ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই এই পদ্ধতিকে অনেক দেশ অবৈধ ঘোষণা করেছে।
আরো পড়ুন- প্রয়োজনে বৈধ ভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠান
হুন্ডিতে টাকা পাঠানো তে অসুবিধা কোথায়?
হুন্ডিতে টাকা পাঠানোতে আসলে একটা বড় সমস্যা আছে। ধরুন একজন বাংলাদেশি ব্যাক্তি আক্কাস, যার কাছে অনেক কালো টাকা আছে। সে এটি বাংলাদেশে খরচ করতে পারছেনা, কারণ এতে করে তার সমস্যা হতে পারে।
এই অবস্থায় হুন্ডি আক্কাসের জন্য কাজ করতে পারবে এবং তাকে সহায়তা করতে পারবে। এখানে আক্কাস তার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দিতে পারবে, যার কোনো প্রমাণও সরকারের কাছে থাকবে না।
এখন আক্কাসের টাকাতো আর বিদেশে চলবে না। যার সমাধানও হুন্ডি নিজেই দিয়ে দিচ্ছে। তারা আক্কাসের হয়ে বিদেশে কোথাও ডলার ট্রান্সফার করে দিবে আর আক্কাস থেকে নেয়া দেশে তাদের এজেন্টের কাছে রেখে দিবে।
কিন্তু হুন্ডি এই ডলার পাবে কই? ধরুন রহিম বিদেশে কাজ করে হন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠায়। এখানে হুন্ডি তার থেকে ডলার সংগ্রহ করে তার কাছে রেখে দিচ্ছে। আর দেশে আক্কাসের থেকে নেয়া টাকা রহিমের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
আর রহিমের কাছ থেকে যে ডলার হুন্ডি সংগ্রহ করেছে, তা আক্কাসের জন্য হুন্ডি আক্কসের ডেস্টিনেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। মাঝখানে তারা শুধু মধ্যস্থতা করছে এবং কিছু লাভ করছে।
তারমানে নিশ্চঃই বুঝতে পারছেন এখানে দেশের কতোটা ক্ষতি হচ্ছে। এখানে দূর্ণিতিবাজরা পাচ্ছে প্রশ্রয় দেশ হারাচ্ছে তার মূল্যবান সম্পদ। আর এই প্রকৃয়ায় আসা রেমিটেন্সও দেশের কোনো কাজে আসছে না।
হুন্ডি বিসনেস ইন বাংলাদেশ
আইএলও এর তথ্য মতে বাংলাদেশে যে রেমিটেন্স আসে তার প্রায় ৩০ শতাংশ আসে এই হুন্ডি সিস্টেমের মাধ্যমে। এটি কোনো ছোটো খাটো বিষয় নয়। বোঝাই যাচ্ছে প্রোবাসিদের মধ্যে এই মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা অনেক বেশি।
তবে যেমনটা বলেছি, এই হুন্ডি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে ইদানিং কালে খুবই কঠোরতা প্রদর্শন করছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে এই হুন্ডির দৌরাত্ন রুখতে।
হুন্ডি রোধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিছুদিন আগে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স বিতরণের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের অনেক এজেন্টের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে হুন্ডি কেন জনপ্রিয়?
হুন্ডির দেয়া টাকার রেট এবং দ্রুততম সময়ে টাকা পৌছানোর জন্য, আর এর কোনো আলাদা ফর্ম পূরণের ঝামেলা না থাকায় এটি অনেক ক্ষেত্রে বেশি সুবিধাজনক মনে করেন গ্রাহকরা।
আমাদের দেশের একটি বড় সংখ্যাক লোক বিদেশে শ্রমিক হিসেবে যায়। তারা যখন দেশে টাকা পাঠান তখন সাধারণ ব্যাংকিং সিস্টেমের ফর্ম পূরণ এবং অন্যান্য নিয়ম গুলো তাদের কাছে অনেক ক্ষেত্রে কঠিন মনে হয়, যা তাদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে অনুৎসাহিত করে।
আবার দেশে অনেক দূর্ণিতিবাজ লোকেরা তাদের অবৈধ অর্থ হস্তান্তরের একটি ভালো মাধ্যম বিবেচনা করে হুন্ডিকে। এমন আরো বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে হুন্ডি অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
হুন্ডি প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা
হুন্ডি প্রতিরোধে কিছুদিন আগে সারাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার সিস্টেম চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে শুধু বৈদেশিক লেনদেনে নিয়োজিত অথরাইজড ডিলার ব্যাংকগুলোর (এডি) শাখা থেকেই নগদ ডলার কেনাবেচনার অনুমতি রয়েছে।
হুন্ডি আইন ও শাস্তি
যেহেতু মানিলন্ডারিং এর আওতায় টাকা পাচার সংক্রান্ত বিচার করা হয়, আর হুন্ডির কার্যক্রম মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে, তাই এই আইনের আওতায় এর বিচার করা হয়।
উক্ত আইনে, মানিলন্ডারিং অপরাধের শাস্তি রাখা হয়েছে:
- ব্যক্তির ক্ষেত্রে: অন্যূন ৪ বছর এবং অনধিক ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুন মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ড।
- প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে: অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদন্ড এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা।
ইসলামের দৃষ্টিতে হুন্ডি ব্যবসা কি হালাল?
যেহেতু এই হুন্ডির মাধ্যমে যারা বড় বড় চোরাচালান করে তারা অবৈধভাবে এর সুযোগ নিচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। তাই এটি বলা যেতেই পারে যে হুন্ডির কার্যক্রম একটি বড় সার্থের জন্য অকল্যাণকর।
হুন্ডি নিয়ে আলেমগণের মতামত এমন যে “যেহেতু এই সিস্টেম রাষ্ট দ্বারা নিষিদ্ধ, এই সিস্টেম দ্বারা অবৈধ কাজকে প্রমোট করা হয়, অনেক বড় বড় অবৈধ কাজ কারবার চলে এই সিস্টেমে, রাস্ট্রের বৃহৎ স্বার্থকে এখানে অগ্রায্য করা হয়, সুতরাং এই সিস্টেম কখন হালাল হতে পারে না।
শরিয়ার দিক থেকে যদি অবৈধ নাও হয়, কিন্তু যদি তা যদি সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক হয়, তাহলে শরিয়া আমাদের সেটা মানার জন্য উদ্ভদ্ধ করে। তাই এটা আমাদের মানা উচিত।
আরো পড়ুন: ইসলামীক ব্যাংকিং
বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর আরো কিছু উপায়
- বিদেশ থেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকে টাকা পাঠানোর নিয়ম
- বিদেশ থেকে সোনালী ব্যাংকে টাকা পাঠানোর নিয়ম
- দুবাই থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর নিয়ম
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর উপায়
- বিদেশ থেকে অগ্রণী ব্যাংকে টাকা পাঠানোর নিয়ম
রেমিটেন্স নিয়ে আরো জানতে পড়ুন Remittance এই পোস্টি। হোমে যেতে ক্লিক করুন Bankline.