মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা

বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ব্যক্তি এবং সমাজকে এটি কুরে কুরে খাচ্ছে। এর যেমন স্বাভাবিক ও যৌক্তিক কারণ আছে, তেমনি আবার কৃত্রিম সংকটও রয়েছে। কাঁচামালের উৎপাদন, বিপণন এবং সরবরাহ ব্যয় বেড়ে যাওয়াতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে এর একটি যৌক্তি কারণ হয়তো থাকতে পারে।

ADVERTISEMENT

কিন্তু এ বৃদ্ধি যদি হয় অস্বাভাবিক আর কৃত্রিম, তখন এখানে এর কোনো যৌক্তিকতা থাকতেই পারে না। এটি তখন পুরো সমাজকে গভিরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা বিলাসী মানসিকতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। এ জন্য ইসলাম আমাদের বিলাসিতা এবং লোভের ব্যাপারে কড়াভাবে সতর্ক করেছে।

কেননা, একটি জাতি নষ্ট হওয়ার জন্যই বিলাসিতাই দায়ী। এই কারণেই একটি উন্নত জাতির পতন হয়। এ বিলাসিতার সবচেয়ে খারাপ সাইট হচ্ছে, এটি মানুষ দুনিয়ামুখী ও আখেরাতবিমুখ করে দেয়। বিলাসিতাকে কুরআনে অত্যন্ত নিন্দনীয় বিষয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

ADVERTISEMENT

বিলাসিতার বিষয়ে কুরআন হাদিসের বানী

”অতএব, তোমাদের পূর্বের প্রজন্ম গুলোর মধ্যে এমন প্রজ্ঞাবান কেন হয়নি, যারা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করত? অল্পসংখ্যক ছাড়া যাদের আমি তাদের মধ্য থেকে নাজাত দিয়েছিলাম। আর যারা জুলুম করেছে, তারা বিলাসিতার পেছনে পড়েছিল এবং তারা ছিল অপরাধী। তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে কোনো জনপদ ধ্বংস করবেন। এ অবস্থায় তার অধিবাসীরা সদাচারী।” (সূরা হুদ: ১১৬-১১৭)।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বলেন, রাসূল (সা.) তাকে ইয়ামানের গভর্নর করে পাঠানোর সময় উপদেশ দিয়ে বলেন: ‘তুমি বিলাসিতা থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহর খাঁটি বান্দারা বিলাসী নয়।’ (সহি তারগিব তারহিব: ০২/২৪৬)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.)-এর কাছে একটি পাত্রে দুধ ও মধু নিয়ে আসা হয়। তিনি বললেন: ‘একই পাত্রে দুই জাত? আমি এটি খাবও না, হারামও করব না।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ০৫/৩৭)।

ADVERTISEMENT

ইসলামি বিজয়াভিযান শুরু হলে সাহাবাগণ ভোগ-বিলাসের ক্ষতি সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারেন। ফলে, তারা একে অন্যকে এব্যাপারে নসিহত করতেন।

আবু উসমান নাহদি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘হযরত ওমর (রা.) আমাদের পত্র লিখলেন, আমরা তখন আজারবাইজান অভিযানে ছিলাম, ”হে উৎবা! এ সম্পদ তোমার অথবা তোমার বাবা-মার কষ্টার্জিত নয়। অতএব, এর থেকে তুমি নিজের ঘরে যেমন পেটপুরে খাও, তেমনি মুসলিমদের বাড়ি গিয়ে তাদের তৃপ্তিসহ খাওয়াও। সাবধান! বিলাসিতা, মুশরিকদের বেশভূষা এবং রেশমি কাপড় পরিধান করা থেকে বেঁচে থাকবে।” (সহি মুসলিম: হা. ৫২৩৭)।

আরো পড়ুন- ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ কিনা

বিলাসিতার কারণে যেসব সমস্যায় পড়তে হয়

বিলাসিতার কারণে পড়া কিছু সমস্যার কথা এখানে কিছু তুলে ধরা হলো-

ADVERTISEMENT
  • বিলাসিতা এবং ভোগবাদ মানুষকে সম্পদ অর্জনে প্রতিযোগী করে তোলে।
  • বিলাসিতা এবং ভোগবাদের কারণে আত্মা পাষাণ হয়ে যায় ও আখেরাত বিস্মৃত হয়ে যায়।
  • বিলাসী জাতির দ্রুত পতন আর পরাজয় ঘটে।

মুদ্রাস্ফীতির ভয়াল থাবা থেকে বাঁচতে ইসলামি শরিয়তের নীতিমালা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

মুদ্রাস্ফীতি থেকে বাঁচতে ইসলামি শরিয়তের নীতিমালা

আল্লাহ মগ্নতায় নিজেকে গড়ে তোলা


কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘আর যদি জনপদগুলোর অধিবাসীরা ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও জমিন থেকে বরকতগুলো তাদের ওপর খুলে দিতাম; কিন্তু তারা অস্বীকার করল। অতঃপর তারা যা অর্জন করত তার কারণে আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সূরা আরাফ: ৯৬)। তাকওয়া হচ্ছে রিজিক বৃদ্ধি ও বরকতের কারণ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা তালাক: ০২-০৩)।

ADVERTISEMENT

আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও দোয়া করা

‘‘আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল’। ‘তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন,‘আর তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের জন্য বাগ-বাগিচা দেবেন আর দেবেন নদী-নালা’।” (সূরা নূহ: ১১-১২)।

আরেক আয়াতে এমনটি এসেছে যে, ‘আর আমি তোমাদের পূর্বেকার জাতিগুলোর কাছে বহু রাসূল পাঠিয়েছি, আমি তাদের প্রতি ক্ষুধা, দরিদ্রতা ও রোগব্যাধি চাপিয়ে দিয়েছি, যেন তারা নম্রতা প্রকাশ করে আমার সামনে নতি স্বীকার করে। সুতরাং তারা কেন বিনীত হয়নি, যখন আমার আজাব তাদের কাছে আসল? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছে। আর তারা যা করত, শয়তান তাদের জন্য তা শোভিত করেছে।’ (সূরা আনআম: ৪২-৪৩)।

আরো পড়ুন- ইসলামে সুদ হারাম হওয়ার বিধান

জাকাত ও সদকা আদায় করা

জাকাতের মধ্য দিয়ে গরিব-অসহায় মানুষকে সাহায্য করা হয়। ধনীদের হাত থেকে নিয়ে গরিবদের হাতে অর্পণ করা হয়। এভাবে সম্পদ সমাজের একশ্রেণির মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার বীপরিতে সুষমভাবে বণ্টিত হয়ে আর্তমানবের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। যার ফলে, সমাজ দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পায়। আর জাকাত না দিলে বিপদ আসে, মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

ADVERTISEMENT

আজকে সমাজের শ্রেণি বৈষম্য আর হানাহানির মূল কারণ হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব না থাকা। জাকাতের মাধ্যমে সম্পদে আরো বরকত আসে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। এতে করে যেমনিভাবে বুর্জোয়াদের দৌরাত্ম্য কমে যায়, আর তেমনি সর্বহারা শ্রেণিরও উদ্ভব ঘটে না।

পরিতৃপ্ত মানসিকতা লালন করা

রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তা নিয়ে খুশি থাক। সর্বাধিক ধনী হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি: হা. ১৮৭৬)। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মাসের পর মাস চলে যেত, রাসূল (সা.)-এর ঘরে আগুন জ্বলত না (অর্থাৎ, কোনো কিছু রান্না করা হতো না)। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে আপনারা কী খেতেন? তিনি বললেন, খেজুর ও পানি। (বুখারি: হা. ৬৪৫৯)।

পরিমিতিবোধ জাগ্রত করা, অপচয় রোধ করা

বিলাসিতার আরেকটি ধরন হলো নানা রকমের খাবারের আয়োজন। যা একটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোয় যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয়, এতে করে যেমনিভাবে আমরা আমাদের গুনাহের বোঝা ভারী করছি, তেমনি অসহায় মানুষের হক নষ্ট করছি। ডাক্তারদের মতে, আল্লাহতায়ালা এ আয়াতেই সব চিকিৎসা রেখে দিয়েছেন-‘এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আরাফ: ৩১)।

ADVERTISEMENT

প্রয়োজন পরিমাণ খাবার আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য বৈধ করে দিয়েছেন। তবে অপচয় করা যাবে না। সর্বক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ জাগ্রত করতে হবে। এমন যেন না হয় যে আজকে আছে তো যথেচ্ছা ভক্ষণ করলাম। কিন্তু আগামীকাল ক্ষুধার্ত থাকলাম। এটা কোনো সুস্থ চিন্তা কখনই হতে পারে না।

মজুতদারি ও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা

ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিধিবদ্ধ পন্থায় বা নিয়ম অনুযায়ি পণ্য মজুত করা ন্যায়সংগত। কিন্তু বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার উদ্দেশ্যে পণ্য মজুত করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। হাদিসে এসেছে, ‘চল্লিশ দিন যে পণ্য মজুত করে রাখবে, সে আল্লাহর থেকে এবং আল্লাহ তার থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ: হা. ৪৮৮০)।

লেখকঃ ওলিউর রহমান, ধর্মীয় গবেষক।

আরো পড়ুন- ব্যাংকে চাকরি হালাল না হারাম

ইসলামী ব্যাংকের সুদইসলামি ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?
ইসলামীক ব্যাংকিংইসলামীক ব্যাংকিং সম্পর্কে আরো দেখুন
হোমে যানbankline
ADVERTISEMENT

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *