ইসলামি ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?

জনসাধারণের একটি কমন প্রশ্ন হলো, ”ইসলামি ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায় না”? আজকে চলুন এই প্রশ্নের একটি ছোটখাটো পোস্টমটেম করা যাক।

ADVERTISEMENT

বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। এখন এ ধরনের ব্যাংকের সংখ্যা দেশে ১০টি। দেশের ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে জনসাধারণের আছে নানা আলোচনা সমালোচনা আর জিজ্ঞাসা।

ইসলামে মূলত সুদকে হারাম করা হয়েছে। যে কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সুদি ব্যাংক থেকে সরে দিনে দিনে ইসলামি ব্যাংকগুলোর দিকে ঝুকে পড়ছে। তবে সাধারণ অনেককে এমনটা বলতে শোনা যায় যে, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের নামে যা হচ্ছে, তা একটা কৌশলমাত্র। এদের কার্যক্রম প্রচলিত ব্যাংকের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়।

ADVERTISEMENT

দেখা যায়, প্রচলিত ব্যাংকগুলো যে প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, ঐ একই প্রকল্পে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোও ইনভেস্ট করছে। এতে যে প্রশ্নটা আরো জোরালো হয়ে দেখা দেয়, ইসলামি ব্যাংকগুলো কি তবে ঘুরিয়ে সুদ খায় না? চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।

ইসলামি ব্যাংকিং-এর মূলনীতি কি?

ইসলামি ব্যাংকিং-এ যুক্ত আছেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, ইসলামি ব্যাংকিং দুটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, লাভ এবং লোকসানের ভাগ নেওয়া ও সুদ (রিবা) তথা সুনির্দিষ্ট হারের ভিত্তিতে লেনদেন না করা।

ADVERTISEMENT

ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকের প্রধান এবং অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সুদের কোনো প্রকার লেনদেন হয় না। এই ব্যাংক ১০০% শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। অন্য ব্যাংক গুলোরও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রচলিত ব্যাংকিং ও ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মধ্যে মূল পার্থক্যের জায়গাটাই হলো সুদ।

আরো পড়ুন- স্কলারদের থেকে জানুন ব্যাংকে চাকরি হালাল না হারাম

মনিটরিং করে সুপারভাইজরি কমিটি বা শরিয়া বোর্ড

ইসলামি ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকের ইসলামিক শাখাগুলো পুরোপুরি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী চলে কি না সেটা দেখার জন্য প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব একটি শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটি রয়েছে বলে জানা গেছে।

একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে শরিয়া আইনের আলোকে তাদের ব্যাংকগুলো চলছে। এছাড়া ”সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ” বেসরকারিভাবে ব্যাংকগুলোর তদারকি করে থাকে।

ADVERTISEMENT

এ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক কখনও টাকার ব্যবসা করে না। সম্পদভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনায় পণ্যের হাতবদলের মাধ্যমে প্রকৃত বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ব্যাংকটি। তাই ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহর নীতিমালা শতভাগ পরিপালন করছে। সুদভিত্তিক ব্যাংক গুলো শরিয়াহ আইন মেনে চলে না। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লেনদেনের কোনও ক্ষেত্রে মিলে যেতেও পারে। যেমনটি মানুষ হিসেবে একজন মুসলিম ও একজন অমুসলিমের বাহ্যিক মিল থাকবে। তবে আসল পার্থক্য থাকবে বিশ্বাস ও কাজেকর্মে।

এই নিয়ে সোশাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলেন, ‘প্রচলিত ও ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য মূলত হালাল-হারামের। ইসলামি ব্যাংকগুলোতে হালাল পদ্ধতিতে লেনদেন হয়ে থাকে। এর মধ্যে কিছু কাজ প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে মনে হলেও আসলে তা শরিয়াহ মেনে চলায় ইসলামি ব্যাংকিং প্রক্রিয়াগত জায়গা থেকে আলাদা। সাধারণ মানুষ অনেক সময় এই মিলে যাওয়াকে ঘুরিয়ে সুদ খাওয়া বলে থাকে। বাস্তবে এমনটা হয় না।

ফলাফল অভিন্ন হলেও আছে নীতিগত পার্থক্য

সুদ এবং মুনাফার পার্থক্য না বোঝার কারণেও অনেকে ইসলামি ব্যাংকগুলোকে সুদি ব্যাংকের সঙ্গে তুলনা করেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা একটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।

ADVERTISEMENT

তিনি বলেন, প্রচলিত ব্যাংকে গিয়ে যদি বলেন গাড়ি কিনবো। তবে তারা বলবে, ১০০ টাকা নিন, ১০ টাকা সুদ, টোটাল ১১০ টাকা ফেরত দিতে হবে। আর ইসলামি ব্যাংকে গাড়ি কেনার কথা বললে তারা বলবে, আমরা টাকা দিতে পারবো না, তবে গাড়িটা কিনে দেবো। আর গাড়ি যদি এখনই চান, তবে ব্যাংক ১০০ টাকায় তা কিনবে এবং আপনার কাছে ১১০ টাকায় বিক্রি করবে। ১০ টাকা ব্যাংকের লাভ।

আবার গ্রাহক যদি বলে এক বছর পরে টাকা দিতে, তখন গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের একটা চুক্তি হবে। তখন তাকে ২০ টাকা লাভ দেওয়ার কথাও বলা হতে পারে। অর্থাৎ এই চুক্তির সঙ্গে প্রচলিত ব্যাংকের ২০ শতাংশ সুদ নেওয়ার ঋণচুক্তির খুব একটা পার্থক্য আসলে নেই। তবে মৌলিক পার্থক্য হলো ইসলামি ব্যাংক গ্রাহকদের সরাসরি টাকা দেয় না। তারা পণ্য কিনে দেয়। আবার যদি ঋণ শোধ দিতে না পারে, তবে ইসলামি ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছে অতিরিক্ত চার্জও করবে না। কিন্তু প্রচলিত ব্যাংক তা করে থাকে।

ইসলামী ব্যাংকের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক মুশারাকা এবং মুদারাবা কারবার ছাড়া কাউকে সাধারণত নগদ অর্থ ঋণ দেয় না। মুরাবাহা পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের অর্ডার মোতাবেক পণ্য ক্রয় করে গ্রাহকের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে। পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা লাভ করা শরিয়াহসম্মত।

আরো পড়ুন- ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ কিনা

লিভ টুগেদার-বিয়ে এবং সুদ-মুনাফা (উদাহরণ)

ইসলামী ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এক ব্যক্তি জনসমক্ষে অপর এক ব্যক্তিকে যদি বলে, আপনি আপনার মেয়েকে লিভ টুগেদারের জন্য আমার কাছে সমর্পণ করুন। এর বিনিময়ে আমি এক লাখ টাকা দেবো। তখন লোকটি ও তার মেয়ে যদি এ প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহলে তারা যে কাজ করবেন তা একটি খুবই জঘন্য অপরাধ।

ADVERTISEMENT

পক্ষান্তরে লোকটি যদি এভাবে বলেন যে, আপনি আপনার মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিন। আমি বিয়ের জন্য মোহরানা এক লাখ টাকা ধার্য করছি। তখন লোকটি এবং তার মেয়ে যদি এ প্রস্তাবে রাজি হন তা হলে কাজটি শরিয়াহ অনুযায়ী বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে।

দুটির মধ্যে পার্থক্য এটুকু যে, একটিতে বিয়ে ও মোহরানা শব্দ দুটি অনুপস্থিত, অপরটিতে তা উল্লেখ করা হয়। ইসলামি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংকের পার্থক্য অনেকটা এমনই। কাজ গুলো দৃশ্যত একরকম মনে হয় বলে অনেকে সুদ ও মুনাফায় গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এখানে মৌলিক পার্থক্য আছেই।’

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা জানান, ‘প্রচলিত ব্যাংকে টাকা জমা রাখা ও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ থাকে। ফলে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদাতার সম্পর্ক ছাড়া আর কোনও দায় দায়িত্ব থাকে না। তাদের চুক্তিটি মূলত সুদ দেওয়া নেওয়ার একটি চুক্তি। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকিং-এ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক এমটি হয় যেন তারা ক্রেতা ও বিক্রেতার।’

ADVERTISEMENT

আরো পড়ুন- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা

ইসলামীক ব্যাংকিং ক্যাটাগিরিইসলামীক ব্যাংকিং
হোমে যানbankline
ADVERTISEMENT

Similar Posts

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *