স্কলারদের থেকে জানুন ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ কিনা
ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার কথা ভাবছেন? কিন্তু তা জায়েজ হবে কিনা তা নিয়ে দিধাদন্ধে আছেন? এই পোস্ট থেকে দলিল সহ জেনে নিন ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ হবে কিনা।
বর্তমান সময়ে আমাদের মুসলিমদের একটি বড় প্রশ্ন হলো “ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ ?”। যেহেতু লোন নেয়া অনেক ক্ষেত্রে এখন আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এনিয়ে আমাদের উদ্বেগ থাকে যে লোন নেয়া উচিত নাকি অনুচিত।
তবে ব্যাংক থেকে ঋণ করা কি জায়েজ কিনা এ ব্যাপারে আপনার উচিত ইসলামীক স্কলারদের শোনা। আজকের এই পোস্টে আমি এমনি কিছু ইসলামীক স্কলাররা কি বলেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু দলিল, অর্থাৎ কুরআন হাদিসের বানিও এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এখানে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি হারাম কিনা এই প্রশ্নের উত্তর এর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ জায়েজ হওয়ার কিছু শর্ত, ও ইসলামী ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ কিনা তা তুলে ধরবো আজকের এই পোস্টে। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
Table of Contents
ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ
একজন মুসলিম হিসেবে, একটি কথা আমরা পালন করি বা না করি, আমরা সবাই জানি যে সুদ হারাম। আর লোনের প্রধান ভিত্তিই হলো সুদ। ব্যাংকের যেহেতু সুদ সহ লোন দিতে হয়, তাই এ লোন কখনো হালাল হতে পারে না। তাই কেউ যদি জানতে চান যে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ কিনা, তবে উত্তর এক বাক্যে বলা যায় যে তা জায়েজ নয়।
এখন কোনো লোনই কি জায়েজ হবে না? হবে যদি তা জায়েজ হওয়ার শর্ত পূরণ করে। অর্থাৎ ইসলামীক ব্যাংকিং ব্যবস্থার কিছু নিয়ম, কিছু গাইড লাইন বিজ্ঞ আলেমরা ঠিক করে দিয়েছেন। এই গাইড লাইন মেনে যে ব্যাংক আপনাকে লোন দিবে সেই লোন জায়েজ হবে বলে ধরা যায়।
ব্যাংকের ঋণ হারাম, তাহলে কি ব্যাংকের চাকরিও হারাম? এটিও বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ”ব্যাংকে চাকরি হালাল না হারাম” এই পোস্টি।
ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হারাম কেন?
সুদ বা রিবা যা বর্তমান ব্যাংক ঋণের সাথে অতপ্রত ভাবে জরিত, তা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম করা হয়েছে। এই সুদের সাথে জরিতদের কঠিন শাস্তির ব্যাপারে বারবার কোরআনে ও হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। এমনি কিছু সতর্কবানী আসুন দেখে নেয়া যাক।
- সাতটি ধ্বংসাত্মক মহাপাপ: রাসুলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকো। সাহাবায়ে কেরাম এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কী? জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া, সতী মুমিন নারীদের অপবাদ দেওয়া। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৬৬)
- সুদের সাথে জরিত সবাই অভিশপ্ত: বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে তার সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) লানত করেছেন। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২০৬)
- সুদখোর আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত: সুদখোর ব্যাক্তি স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৮-২৭৯)
- সুদখোররা ব্যভিচারকারীর সমতুল্য: বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যভিচার বেশি নিন্দনীয়। আর স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া সেখানে কী পরিমাণ জঘন্য হতে পারে? সুদখোর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে তার মায়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমান অপরাধে অপরাধি। বর্ণিত আছে যে, ‘সুদ সত্তর প্রকার পাপের সমষ্টি। তার মাঝে সবচেয়ে নিম্নতম হলো—আপন মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করার সমতুল্য পাপ। ’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ১৫৩৪৫)
- ইবাদত কবুলের একটি পূর্বশর্ত: ইবাদত মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পূর্বশর্ত হলো আপনাকে হালাল পন্থায় উপার্জিত সম্পদ থেকে আহার করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে যে, ‘হে রাসুলরা, তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো। ’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৫১) হারাম পন্থায় উপার্জিত অর্থ থেকে আহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘বৈধ জীবিকার ইবাদত ছাড়া কোনো ধরনের ইবাদত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৩০)
এছাড়া আরো অনেক দলিল পাওয়া যায় এই সুদখোরদের বিরুদ্ধে। যা হারাম তা হারামই, হোক তা অল্প বা বেশি। ব্যাংকের লোনের সুদ কম হলেও তা সুদই। তাই সুদি ব্যাংকের ব্যাংক লোন জায়েজ হবে না।
আরো পড়ুন- ইসলামি ব্যাংকগুলো কি ঘুরিয়ে সুদ খায়?
ব্যাংক ঋণ জায়েজ হওয়ার কিছু শর্ত
আপনার নেয়া ব্যাংক ঋণ জায়েজ হতে পারে। যদিনা এই ঋণ জায়েজ হওয়ার শর্ত মেনে চলে। এখানে যেসকল শর্ত মেনে চলতে হবে তা নিচে তুলে ধরা হলো।
১. ব্যাংকের মালিকানায় বা দখলে পণ্য আসার আগেই তা বিক্রি করতে পারবে না। অর্থাৎ বিনিয়োগ গ্রহীতা ব্যাংকের কাছে পণ্য চাওয়ার পর প্রথমে ব্যাংককে তা খরিদ করতে হবে এবং তা হস্তগত করতে হবে। অতপর ক্লায়েন্টের নিকট তা বিক্রি করতে পারবে। |
২. ব্যাংক যে পণ্য গ্রাহকের কাছে বিক্রি করবে, গ্রাহক যদি নিজেই এর মালিক হয় এবং সে ব্যাংকের কাছে তা নগদে কমমূল্যে বিক্রয় করে পরে আবার বাকিতে বেশি মূল্যে তা ক্রয় করে নেয়, তখন এই কারবারটি হারাম হবে এবং সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ যার কাছে বিক্রি করবে তার থেকেই পণ্যটি খরিদ করেছে, বিষয়টি এমন হওয়া চলবে না। |
৩. কারবারটি এমন হতে হবে যেন বাস্তবেই ক্রেতার ওই পণ্যের জন্য অর্থ প্রয়োজন। যদি শুধু মাত্র পণ্যের নাম ব্যবহার করে নগদ টাকা ঋণ নেয়, বাস্তবে পণ্য খরিদের কোনো ইচ্ছা নেই, তাহলে কারবারটি হারাম হবে। |
৪. বাস্তব সম্মত ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে। এমন হওয়া যাবে না যে, একটি দোকানে আগে থেকেই ব্যাংকের এমন চুক্তি রয়েছে যে, আমরা তোমার কাছ থেকে কোনো পণ্য খরিদ করে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করলে সে আবার তোমার নিকট কম মূল্যে তা বিক্রি করে দিবে। এধরণের টাল-বাহানা করা যাবে না। |
৫. ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগ প্রার্থী যদি এমন জিনিস খরিদের নামে টাকা নেয়, যা আগেই সে খরিদ করে ফেলেছে অথবা তা কাজে লাগিয়ে ফেলেছে, এখন ঐসব পণ্যের বকেয়া মূল্য পরিশোধের জন্য অথবা টাকার অন্য কোনো প্রয়োজন হওয়ায় ওই পণ্যের নামে ব্যাংকের সঙ্গে মুরাবাহা করছে, তবে তাও হবে হারাম এবং সুদি কারবার। |
৬. মুরাবাহার আরেকটি শর্ত হলো গ্রাহকের কাছে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য সেল করে দেওয়ার পর তা আর বৃদ্ধি করা যাবে না। অর্থাৎ সনাতনী ব্যাংকগুলো যেমন বছরান্তে বা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুদের হার বৃদ্ধি করে দেয়, সেভাবে মুরাবাহা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। করলে তা সুদের অন্তভূক্ত হবে। |
৭. কোনো প্রকার হারাম পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। |
ইসলামী ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া কি জায়েজ
ইসলামী ব্যাংকের লোন বলতে কিছু নেই। যা আছে তাহলো বিনিয়োগ। ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ দিয়ে থাকে। নিচে কিছু বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলা যাক।
১. বাড়ি করার জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি সরাসরি ব্যাংক থেকে টাকা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ বাড়ি করার জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র, যেমন- রড, সিমেন্ট, বালি ইত্যাদি, আপনি ক্রয় করতে পারবেন না। এগুলো ব্যাংক করবে। এখানে ব্যাংকের সাথে আপনার শুধু চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। ব্যাংক এখানে ইনভেস্ট করছে আপনার বাড়ি নির্মাণ করার জন্য।
২. ফ্রিল্যান্সিং লোন হিসেবে একজন ফ্রিল্যান্সার যে ধরনের জিনিসপত্র ক্রয় করতে হয় তার সব ধরনের জিনিসপত্র এই ঋণের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ আপনি পন্য পাবেন এবং পরে আপনার টাকা পরিষোধ করতে হবে।
৩. তারপর মহিলা বিনিয়োগ পদ্ধতির আন্ডারে মহিলাদের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা প্রসারিত করতে সমাজের নারীদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বিনিয়োগ করে থাকে।
আরো জানতে নিচে থাকা ”ডঃ মনজুর ইলাহি”-র ভিডিওটি দেখুন:
ইসলামী ব্যাংকের ঋণ সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন “ইসলামী ব্যাংকের ঋণ নেয়ার নিয়ম” এই পোস্টি।
ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করা কি জায়েজ?
সুদি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করা জায়েজ হবে না। এই সুদি ব্যাংকের লোন নেয়াও উচিত না যতক্ষন না আপনার জীবণ বিপন্ন হওয়ার সংকা থাকছে। আপনি যা করতে পারেন তা হলে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নিতে পারেন। বিনিয়োগ বা ব্যবসা কে হালাল ধরা হয়, যতক্ষণ সেগুলো নিয়মের মধ্যে থাকছে।
ব্যাংক লোন সম্পর্কে স্কলারদের কথা শুনুন
এখানে ব্যাংক লোন সম্পর্কে Sheikh Ahmadullah এর কিছু বক্তব্য দেয়া হয়েছে। শায়েখের বক্তব্য অনুসারে আপনি যদি এমন কোনো সিচুয়েশনে না পড়েন যেখানে আপনার জীবণ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে আপনার লোন নেয়া উচিত নয়। আর যদি এমন সম্ভাবনা থাকে তবে আপনি তা নিতে পারেন জীবণ রক্ষার জন্য, তা আল্লাহ মাফ করবেন বলে আশা করা যায়। আরো জানতে নিচে ভিডিওটি দেখুন।
ব্যাংক লোন নিয়ে ডাঃ জাকির নায়েকের মতামত
শেষকথা
পুরো আর্টিকেলের যদি একটি সামারি করি তাহলে এটা বোঝা যায় যে আপনার জন্য ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া জায়েজ হবে না, যদি সেটা সুদি ব্যাংক হয়। বর্তমানে প্রায় সব ব্যাংকই সুদি ব্যাংক। এখানে তাই লোন নেয়া জায়েজ হবে না।
অন্যদিকে এখন আমাদের সাথে ব্যাংক বা লোন অনেকাংশে অতপ্রত ভাবে জরিত। এখানে লোন ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তাই আমরা সুদি ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে যেটা নিতে পারি তা হলো ইসলামী ব্যাংকের সাহায্য। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লোন বলতে কিছু নেই। তাদের যা আছে তা হলো বিনিয়োগ।
ইসলামী ব্যাংক গুলো যদি বিনিয়োগের শর্ত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা মেনে আপনার কাজে বিনিয়োগ করে তবে তা আপনার জন্য হালাল হবে। তাই আপনি বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতি নিতে পারেন।
আর যদি এমন হয় যে ইসলামী ব্যাংক থেকে এই মূহুর্তে বিনিয়োগ নেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আপনার টাকার খুব দরকার এবং টাকা না পেতে আপনার জীবণের ঝুকি আছে। সেক্ষেত্রে আপনি লোন নিতে পারেন। আর যদি এমন কিছু না হয় তবে আপনার তা নেয়ার দরকার নেই।
আরো পড়ুন- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা
ইসলামীক ব্যাংকিং | ইসলামীক ব্যাংকিং সম্পর্কে আরো দেখুন |
হোমে যান | bankline |