প্রচলিত মুদ্রা ব্যবসায় ইসলামী শরীআহ’র বিধান
মহান আল্লাহ তাআলার বাণী “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত নং ২৭৫)। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় তথা ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ করা হয়েছে। ক্রয়-বিক্রয়…
মহান আল্লাহ তাআলার বাণী “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত নং ২৭৫)। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় তথা ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ করা হয়েছে। ক্রয়-বিক্রয় বলতে এক পণ্যের বিনিময়ে অন্য পণ্যের লেনদেনকে বুঝায়। ইসলামে কী সব ধরণের পণ্যের বিনিময় বৈধ? এ বিষয়ে শরীআহ’র সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা রয়েছে, যা রাসুল (স) এর হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। ব্যবসা-বাণিজ্য বা লেনদেন সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রয়েছে, তন্মধ্যে বহুল পরিচিত কয়েকটি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো-
হযরত উবাদাহ ইবনুস সামিত (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক গির্জায় অথবা ইহূদীদের ইবাদতখানায় উবাদা ইবনুস সামিত (রা) ও মুআবিয়া (রা) এর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। উবাদা ইবনুস সামিত (রা) তাদের নিকট হাদীস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) আমাদেরকে রুপার বিনিময়ে রুপা, সোনার বিনিময়ে সোনা, গমের বিনিময়ে গম, বার্লির বিনিময়ে বার্লি, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবনের বিনিময়ে লবন বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে গমের বিনিময়ে বার্লি এবং বার্লির বিনিময়ে গম ওজনে কম-বেশি করে যেভাবে ইচ্ছা নগদ বিক্রয় করার অনুমতি দিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ ১৮, মুসলিম ১৫৮৭, তিরমিযী ১২৪০, নাসায়ী ৪৫৬০, আবূ দাউদ ৩৩৪৯, আহমাদ ২২১৭৫, দারেমী ২৫৭৯)
হযরত উবাদাহ ইব্নুস সামিত (রা) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিস, যিনি নবী (স)-এর নিকট এই মর্মে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবেন না। তিনি ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে লোক সকল! তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের এমন কতক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছ, আমি জানি না এগুলো কোন ধরনের? জেনে রাখ, সোনার বিনিময়ে সোনা সমান সমান হতে হবে, তা পিন্ড আকারে হোক বা মুদ্রারূপে হোক। আর রূপার বিনিময়ে রূপা তা পিন্ড আকারে হোক বা মুদ্রারূপে হোক, সমপরিমাণ হতে হবে। সোনার বিনিময়ে রূপা যদি নগদ নগদ হয়, তবে রূপা বেশি হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু বাকিতে বৈধ হবে না। আর জেনে রাখ! গমের বিনিময়ে গম এবং যবের বিনিময়ে যব সমপরিমাণ হতে হবে। কিন্তু যবের বিনিময়ে গম বিক্রয় করলে যব অধিক হলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু হাতে হাতে লেনদেন হতে হবে, বাকিতে বিক্রয় করা চলবে না। আর জেনে রাখ, খোরমার বিনিময়ে খোরমা বিক্রয় হলে সমপরিমাণ হতে হবে, এমনকি তিনি লবণের কথাও এভাবে উল্লেখ করলেন। যদি কেউ বেশি দেয় বা নেয়, তবে সে সুদে জড়িত হল। (সহিহ আল-বুখারী ৪৫৬৩)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, আল্লাহ্র রাসূল (স) বলেছেন, সমান পরিমাণ ছাড়া তোমরা সোনার বদলে সোনা বিক্রি করবে না, একটি অপরটি হতে কম-বেশি করবে না। সমান ছাড়া তোমরা রূপার বদলে রূপা বিক্রি করবে না ও একটি অপরটি হতে কম-বেশি করবে না। আর নগদ মুদ্রার বিনিময়ে বাকি মুদ্রা বিক্রি করবে না। (বুখারী ২১৭৭; মুসলিম ১৫৮৪)
উপরে বর্ণিত হাদিসগুলো থেকে আমরা সহজেই ক্রয়-বিক্রয় তথা লেনদেনের মূলনীতি সম্পর্কে জানতে পারি। শরীআহ’র দৃষ্টিতে একই প্রকারের দুইটি জিনিসকে কমবেশি ক্রয়-বিক্রয় করলে সুদ হয়ে যায়। সে কারণে এমন লেনদেন নাজায়েজ ও নিষিদ্ধ। তবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের দুইটি জিনিস যদি কম-বেশিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তাহলে এটি সুদের অন্তর্ভুক্ত হয় না; তাই এই ধরনের ব্যবসা বৈধ।
তবে মুদ্রার বিষয়টা ভিন্ন। মুদ্রা যেহেতু কোনো পণ্য নয়। বিনিময় বা লেনদেনের অন্যতম একটা মাধ্যম। মুদ্রা বিনিময়ের ব্যাপারে রাসুল (স) এর স্পষ্ট নির্দেশনা হলো একই ধরণের মুদ্রা লেনদেনের বেলায় বাড়িয়ে বা কমিয়ে বা বাকিতে লেনদেন করা যাবে না। বরং মুদ্রার বিনিময় হতে হবে নগদে এবং হাতে হাতে সাথে সাথে। মুদ্রা লেনদেন বিষয়ে ইসলামিক স্কলারগণ বিভিন্ন ধরণের মতামত দিয়েছেন যা এখানে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
সাধারণত মুদ্রার লেনদেন দুইভাবে হতে পারে। যথা- এক. ভিন্ন দেশের কারেন্সির লেনদেন। দুই. একই দেশের কারেন্সির লেনদেন। প্রথম প্রকারের লেনদেনকে ফরেণ এক্সচেঞ্জ বলা হয়। মানে ভিন্ন দুইটি দেশের মুদ্রার লেনদেনকেই ফরেক্স বলা হয়। এক দেশের কারেন্সি আরেক দেশের কারেন্সির বিনিময়ে কম-বেশি করে বিক্রি করা জায়েজ আছে। তবে এক্ষেত্রে এক বৈঠকেই কমপক্ষে একপক্ষ টাকাটি হস্তগত করে নিতে হবে। যদি একজনও তাদের বিনিময়কৃত কারেন্সি হস্তগত না করে, তাহলে ক্রয়-বিক্রয়টি জায়েজ হবে না। (জাদিদ ফিকহি মাসায়িল : ৪/২৮; জাদিদ মুআমালাত কে শরয়ি আহকাম : ১-১৩৯)
এক দেশের মুদ্রা ভিন্ন দেশের মুদ্রার সাথে প্রকার ভিন্ন হওয়ার কারণে কম-বেশিতে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয আছে; যদি কমপক্ষে কোনো এক পক্ষ মুদ্রার ওপর দখল-মালিকানা থাকে। অন্যথায় তা অবৈধ। পক্ষান্তরে দেশি মুদ্রা একই প্রকারের হওয়ার কারণে পরস্পর কমবেশিতে ক্রয়-বিক্রয় শরীআহ’র দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত অংশ সুদ হিসেবে গণ্য হবে। (আদদুররুল মুখতার ৫/১৭১-১৭২; বুহুসুন ফি কাজায়া ফিকহিয়্যা : ১/১৬৩)
উপরোক্ত নিয়মে মুদ্রা-বিনিময় ব্যবসা জায়েয। তবে শর্ত হলো: একই বৈঠকে প্রদান ও গ্রহণ সম্পাদিত হতে হবে। ডলারের বিনিময়ে ইউরো বিক্রি করা জায়েয; শর্ত হলো- একই বৈঠকে গ্রহণ ও প্রদান সংঘটিত হতে হবে। প্রসঙ্গত, দুই দেশের নোটের বিনিময় ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যর ভিত্তিতেই হওয়া চাই। যেমন- এক ডলার (ইউএস) সমান বর্তমানে ১১০.০০ টাকা। তাছাড়া উভয়ে যদি কম-বেশির ওপর সম্মত হন, তাহলে সেটাও জায়েজ। তবে শর্ত হলো- উভয়ের যে কেউ একজন মজলিসে মুদ্রা হস্তগত করবেন।(জাদিদ ফিকহি মাসায়িল : ৪/২৮)
একই দেশের কারেন্সির পরস্পর লেনদেনের সময় সমতা রক্ষা করা আবশ্যক। কম-বেশি করে বিক্রি করলে উক্ত ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হবে না। (হিদায়া, কিতাবুল বুয়ু, বাবুর রিবা : ০৩/৮৫; মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন : ০২/৬৫-৬৬; শারহু মাআনিল আসার : ৫৫৫৪; সুনান দারু কুতনি : ৩০৬০) যেমন এক ডলারের বিনিময়ে দুই ডলার, এটা জায়েয নেই। যেহেতু এটি রিবা আল ফাদল (বৃদ্ধিগত সুদ)। তাই যদি একই মুদ্রার বিনিময় হয়, তাহলে উভয়টি সমান সমান হওয়া ও একই বৈঠকে আদান-প্রদান সম্পাদিত হওয়া আবশ্যক।
শাইখ বিন বাজের ফতোয়াসমগ্রতে এসেছে, “মুদ্রাগুলোর মধ্যে বেচাকেনার লেনদেন জায়েজ। কিন্তু শর্ত হলো- আদান-প্রদান হাতে হাতে সম্পাদিত হওয়া; যদি মুদ্রাগুলো আলাদাশ্রেণীর হয়। তাই কেউ যদি লিবিয়ান মুদ্রার বিপরীতে আমেরিকান মুদ্রা বিক্রি করে কিংবা মিসরী মুদ্রা বা অন্য কোনো মুদ্রার বিপরীতে বিক্রি করে এবং হাতে হাতে বিনিময় হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নাই। যেমন- কেউ লিবিয়ান মুদ্রা দিয়ে নগদে কিছু ডলার কিনল। একই মজলিসে সে এটি গ্রহণ করল এবং অন্যজন অন্যটি গ্রহণ করল। কিংবা মিসরি মুদ্রা কিংবা ইংল্যাণ্ডের মুদ্রা কিংবা অন্যকোনো মুদ্রা লিবিয়ান মুদ্রার বিনিময়ে খরিদ করল— হাতে হাতে; এতেও কোনো অসুবিধা নেই। আর যদি বাকিতে খরিদ করে, তাহলে জায়েজ হবে না।
অনুরূপভাবে একই মজলিসেও যদি একহাতে দেওয়া অন্য হাতে নেওয়া সংঘটিত না হয়, তাহলেও জায়েজ হবে না। কেননা সেটি এক প্রকার সুদি কারবার। তাই অবশ্যই একই মজলিসে হাতে হাতে সংঘটিত হতে হবে; যদি মুদ্রাগুলো ভিন্ন শ্রেণীর হয়। আর যদি এক শ্রেণীর হয় তাহলে দুটো শর্ত পূর্ণ হতে হবে: সমান সমান হওয়া এবং একই মজলিসে এক হাতে নেওয়া অন্য হাতে দেওয়া। দলিল হচ্ছে নবী (সা.)-এর হাদিস, ‘স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ, রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য…’।” (ফতওয়াসমগ্র, শায়খ বিন বাজ: ১৯/১৭১-১৭৪)। চলবে……
লেখকঃ মোঃ খায়রুল হাসান, বাহরাইন ভিত্তিক দ্য অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটস (আওফি)-এর সিএসএএ ফেলো।