ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সহজ শর্তে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে খেলাপি গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান। এবার গ্রুপভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি থাকলেও তাদের অন্য…
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সহজ শর্তে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে খেলাপি গ্রাহকেরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান। এবার গ্রুপভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি থাকলেও তাদের অন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে। এ রকম সুযোগ রেখেই জাতীয় সংসদে সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে খেলাপিরাও ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবে। আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। কয়েকজন ব্যাংক পরিচালকের প্রস্তাবেই সরকার আইনটি সংশোধন করে বলে জানা গেছে।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন আইনের ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে, খেলাপি ঋণ বাড়বে এবং সার্বিকভাবে আমানতকারীদের স্বার্থ ঝুঁকিতে পড়বে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা ঋণখেলাপি, তাদের এখন যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হবে। ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়বে।’
মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত প্রয়োজন। সেই বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত তার অন্তরায়। আমানতকারীদের অর্থের এমন ব্যবহার হবে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’
যেভাবে এই অভিনব সুযোগ
কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক গত মাসে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একটি লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। তাঁরা বলেছিলেন, ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হলে বা যুক্তিসংগত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে সেই ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যাংকগুলো যেন ঋণ দেয়।
ব্যাংক পরিচালকেরা যখন এই প্রস্তাব জমা দেন, তখন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় এমন কোনো ধারা ছিল না। আইনটি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে ছিল। ওই কমিটি সংসদে যে মতামত পেশ করে, তাতেও ব্যাংক পরিচালকদের প্রস্তাবটি স্থান পায়নি।
কিন্তু আইনটি পাসের দিন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম ২৭(কক) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন। তিনি যেভাবে ওই ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন, তা অনেকটা সরকারের উচ্চপর্যায়ে ব্যাংক পরিচালকদের দেওয়া প্রস্তাবের মতো।
সংসদে কণ্ঠ ভোটে এই প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অবশ্য এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন, অর্থাৎ বের হয়ে যান।
আগের আইন অনুযায়ী, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও খেলাপি হয়ে পড়ত। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি ছিল।
কেন এই সুযোগ
গত দেড় দশকে ভোগ্যপণ্যের বাজার, জাহাজভাঙা শিল্পের উত্থান-পতনসহ বিভিন্ন কারণে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েন। তাঁদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ী। আবার বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করেও অনেক ভালো গ্রুপ প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়ে। অনেক ব্যাংক উদ্যোক্তা এসব প্রতিষ্ঠান কিনে নিচ্ছে। আবার অনেক ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ এতে আটকে পড়েছে। এ কারণেই কয়েকজন ব্যাংক উদ্যোক্তা ঋণখেলাপিদের আবার ঋণ দেওয়ার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব দেন।
এই প্রস্তাব প্রক্রিয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না কারার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুধু পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে ১২ বছর করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। লিখিত প্রস্তাবে আরও কিছু দিতে হয়, এ জন্য খেলাপিদের ঋণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবটি যুক্ত করা হয়েছিল। এটাও পাস হয়ে যাবে, সেটা ভাবিনি। এটা ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতির কারণ হলো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, খেলাপিদের ঋণ নেওয়ার আইনি সুযোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কিছু করণীয় থাকছে না। প্রভাবশালী কাউকে ঋণ নেওয়া থেকে বিরত রাখার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। এখন ঋণখেলাপি বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু করতে পারবে না। তবে এই সুযোগ দেওয়ায় সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কমতে পারে। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অনেক সময় পুরো গ্রুপের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
কর্মকর্তারা আরও বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে তারা কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেটাও দেখার বিষয়। কারণ, এর আগে এই প্রক্রিয়ায় একটি গ্রুপকে অর্থায়ন করা হলেও সেটি ভালো করতে পারেনি। এদিকে খেলাপি উদ্যোক্তাকে ঋণ দিলে বিদেশি ব্যাংক ও সহযোগী সংস্থাগুলো সেটাকে কীভাবে দেখবে, তা-ও চিন্তার বিষয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় উঠেছে। খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তা কমানোর পথ খুঁজছে এবং নীতি ছাড় দিয়ে যাচ্ছে।