ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বৈশিষ্ট্য গুলো যেমন হবে

ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও ঋণ গ্রহীতার সম্পর্ক দাতা ও গ্রহীতার। ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতি যাই হোক, সুদের হার পূর্বনির্ধারিত। সঞ্চয়কারীর সুদের হারও পূর্বনির্ধারিত। ব্যাংকের লাভ লোকসানের সঙ্গে গ্রাহকের লাভ-ক্ষতির…

ADVERTISEMENT

ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও ঋণ গ্রহীতার সম্পর্ক দাতা ও গ্রহীতার। ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতি যাই হোক, সুদের হার পূর্বনির্ধারিত। সঞ্চয়কারীর সুদের হারও পূর্বনির্ধারিত। ব্যাংকের লাভ লোকসানের সঙ্গে গ্রাহকের লাভ-ক্ষতির কোনো সম্পর্ক নেই। তার বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী ও ব্যাংকের লাভ-লোকসান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ইসলামী ব্যাংক তার লক্ষ্য অর্জনে স্বতন্ত্র নীতি ও কর্মধারা অনুসরণ করে। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-

ব্যক্তিস্বার্থ নয়-সমষ্টির কল্যাণ

ব্যক্তিস্বার্থ নয়, সামাজিক কল্যাণ ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের মূল কথা। সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি বা আয়ের সৃষ্টি শুধু নয়, তার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা ইসলামী ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এই উদ্দেশ্যে দরিদ্র, স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীনদের জন্য বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা এবং পর্যায়ক্রমে তাদের অবস্থার উন্নয়ন ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য।

ADVERTISEMENT

সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বয়

শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের উন্নয়ন নয়, নয় শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন। মূল্যবোধ সমন্বিত, বহুমুখী ও গতিশীল উন্নয়ন এ ব্যাংকের আদর্শ। এ সমন্বিত উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ নির্মাণ ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য। সামাজিক উন্নয়নই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। ইসলামী ব্যাংক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দুই ধারাকে সমন্বিত করে।

নৈতিক শৃঙ্খলার বিধান অনুসরণ

অর্থ-সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ও আর্থসামাজিক সুবিচার কায়েম ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার লক্ষ্য। এ নৈতিক বাধ্যবাধকতা বা নৈতিক শৃঙ্খলা ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের ভিত্তি। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার নৈতিক বিধানের সার কথা হলো-

  • সব সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক আল্লাহ। মানুষ ট্রাস্টি হিসেবে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে সে সম্পদ অর্জন ও ব্যবহার করবে।
  • মানুষ সম্পদ ব্যবহার করবে ইহকালীন ও পরকালীন ‘হাসানাহ’ ও ‘ফালাহ’ (সুন্দর ও কল্যাণ) আহরণের জন্য।
  • তারা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ‘আদল’ ও ‘ইহসান’ (ন্যায়বিচার ও দয়া) অনুশীলন করবে।
  • তারা ‘মারুফ’ বা কল্যাণমূলক ইনস্টিটিউশন কায়েম করবে। সমাজকে ‘মুনকার’ বা অকল্যাণমূলক সব বোঝা-বন্ধন ও কষ্ট-যাতনা থেকে মুক্ত করবে। এভাবে মানুষের জীবন ভারমুক্ত ও সহজ করবে।

বিনিয়োগে অংশীদারিত্বের নীতি

লাভ-লোকসান অংশীদারি পদ্ধতির ব্যবসায়ে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই লাভ-লোকসানে অংশ নেয়। এ ধরনের কারবারে ব্যাংক ও গ্রাহকের সাফল্য বা ব্যর্থতা এক সুতোয় গাঁথা। ফলে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে একাত্মতা সৃষ্টি হয়। এটি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য।

ADVERTISEMENT

টাকার কারবার নয়-পণ্যের ব্যবসা

ইসলামী ব্যাংক অংশীদারি পদ্ধতি ছাড়াও মুরাবাহা, বায়-ই-মুয়াজ্জল, বায়-ই-সালাম, ইজারা, ভাড়ায় ক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে। ইসলামী ব্যাংক টাকা লগ্নি করে না। পণ্যের বেচাকেনা কিংবা ইজারা পদ্ধতিতে এসব বিনিয়োগ পরিচালনা করে। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় কিংবা দ্রব্যের ভাড়ার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ব্যবসায়িক লাভরূপে গণ্য।

মুদ্রাস্ফীতির কারণ দূর করা

সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় পণ্যের সঙ্গে টাকার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না। সেখানে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যক্রম ছাড়াই নির্দিষ্ট হারে মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ঘটে। এর ফলে মুদ্রার সামগ্রিক সোপান এবং বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়ে যায়। এর ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যা। এর ফলে সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়। এর বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকের পণ্যভিত্তিক বিনিয়োগ কার্যক্রম মুদ্রাস্ফীতির কারণ দূর করে।

বেকারত্ব রোধ ও কর্মসংস্থান

ইসলামী ব্যাংক অত্যাবশ্যকীয়, উৎপাদনমূলক, শ্রমঘন, সামাজিকভাবে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে। ফলে কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত হয়। ইসলামী ব্যাংক সমাজের স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীন লোকদের কর্মসংস্থানে বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণ করে।

ADVERTISEMENT

দাতা-গ্রহীতা নয়-অংশীদারিত্বের সম্পর্ক

সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও ঋণ গ্রহীতার সম্পর্ক দাতা ও গ্রহীতার। ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতি যাই হোক, সুদের হার পূর্বনির্ধারিত। সঞ্চয়কারীর সুদের হারও পূর্বনির্ধারিত। ব্যাংকের লাভ-লোকসানের সঙ্গে গ্রাহকের লাভ-ক্ষতির কোনো সম্পর্ক নেই। সব পক্ষ পূর্বনির্ধারিত সুদ গ্রহণ বা প্রদান করার কারণে তাদের মাঝে পারস্পরিক দায়বোধ গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। তার বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় সঞ্চয়কারী ও ব্যাংকের লাভ-লোকসান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সঞ্চয়কারী, ব্যাংকার ও বিনিয়োগ গ্রহীতা পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ।

ইসলামী শরিয়া নীতি অনুসরণ

ইসলামী ব্যাংক তার জমা গ্রহণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রমসহ সব কাজে শরিয়া নীতি অনুসরণ করে। সুদ উচ্ছেদ করে আর্থিক ক্ষেত্রে প্রকৃত পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ের প্রচলন ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম মূলনীতি। আর্থিকভাবে লাভজনক কোনো ব্যবসা সামাজিক বিবেচনায় অকল্যাণকর হলে ইসলামী ব্যাংক তাতে অংশ নেয় না। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা তদারক করেন স্বাধীন শরিয়া কর্তৃপক্ষ। শরিয়া সুপারভাইজারি কমিটি ব্যাংকের কার্যক্রমে ইসলামী শরিয়া সংক্রান্ত যথার্থতা তদারক করে এবং নিয়মিত পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়।

বঞ্চিত ও অভাবী মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন

সমাজের অভাবী, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের আর্থিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংক দায়িত্ব পালন করে। ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ সমাজের দুর্বল হাতগুলোকে সবল করে। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। অভাবী ও নিঃস্ব অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন পরিবারগুলোকে স্থায়ী এবং স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ইসলামী ব্যাংকের বিশেষ জনকল্যাণ তহবিল থেকে এ জন্য ব্যয় করা হয়।

ADVERTISEMENT

লোভ নয়, প্রয়োজন পূরণ

ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালিত হয় মানুষের স্বভাবসম্মত আর্থিক লেনদেনের সহজ প্রক্রিয়ায়। এ ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও কর্মধারা ব্যাপক জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। গুটিকতেক মানুষের লোভের চাহিদা পূরণে কাজ না করে সমাজের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে আর্থসামাজিক সুবিচার কায়েমে ইসলামী ব্যাংক কাজ করে। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো আর্থসামাজিক লক্ষ্য অনুসরণ করে দেশের ভারসাম্যপূর্ণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে। জনকল্যাণধর্মী, উন্নয়নমুখী এই ভূমিকার মাধ্যমে দেশের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম এরই মধ্যে জনগণের ব্যাপক আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ২৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নমূলক ভূমিকা বিশ্লেষণ করে দেশের নেতৃস্থানীয় তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং খাতের অনেক শীর্ষ ব্যক্তি মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং দেশের মূলধারার ব্যবস্থায় পরিণত হবে এবং একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের গোটা ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হবে। পশ্চিমা আধুনিক ব্যাংকিংয়ের সীমাবদ্ধতা অনেক আগেই অর্থনীতিবিদদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। তার মোকাবিলায় ইসলামী ব্যাংকিং একটি সর্বজনীন আর্থিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষের সামনে মুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। কোরআনের আলোকে মানুষের ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবন গড়ে তুলতে ইসলামী ব্যাংকিং এখন আশার উজ্জ্বল দিগন্ত।

মোঃ আবদুল মান্নান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

ADVERTISEMENT

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *